পাবলিক রিলেশানসের লাস্যময়ী আরিফা ম্যাডামের অধরোষ্ঠে আচমকা চুমু খায় রাজীব। দেশী নয়, একেবারে ফরাসী চুম্বন। আরিফা ম্যাডামের সাথে ইতিপূর্বে রাজীবের কোন আলাপ পরিচয় নেই । ঘটনার আকস্মিকতায় আরিফা ম্যাডাম প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বিহ্ববলতা কাটতেই, চিৎকার করে উঠে। হেড অফিসের কতিপয় ফাজিল পুরুষজনেরা বলে, সেটি ঠিক চিৎকার ছিল না; অনেকটা চিৎকারের সহিত শীৎকারের মিশেল। খবরটি প্রকাশিত হলে, হেড অফিসে হুলুস্থূল ছড়িয়ে পড়ে। সবাই চুম্বন-বৃত্তান্ত কান পেতে শুনে। অচিরেই জানাজানি হয়, যে ব্যক্তিটি, বলা নেই , কওয়া নেই , হঠাৎ আরিফা ম্যাডামকে চুমু খেলো, সে কোম্পানীর একজন সাময়িক বরখাস্ত বিক্রয় প্রতিনিধি। অতি সাধারণ! প্রতীয়মান হতে পারে, চুম্বনকারী অতি সাধারণ না হয়ে, কোম্পানীর বৃদ্ধ চেয়ারম্যান হলে, বিষয়টি সমীচীন হতো। সারা অফিসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে কক্ষে, খুপরিতে খুপরিতে ঘটনাটি ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। গুটিকয় দুষ্ট অফিসার, অফিস বিল্ডিং-এর কোনায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিতে দিতে, আরিফা ম্যাডামের আবেদনময় পোষাক নিয়ে , আরিফা ম্যাডামের সাথে সেলস ডিরেক্টর ইকরাম উল্লাহর ঢলাঢলি নিয়ে, ইংগিতপূর্ণ আলোচনা করে। আলোচনায় রাজীব নামের বরখাস্ত বিক্রিয় প্রতিনিধির আত্মনিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার ভাগ আরিফা ম্যাডামকেও দেয়া হয়।
এর আগে অন্তত: দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন, রাজীব যখন সেলস ডিরেক্টরের কেবিনের বাইরে পেতে রাখা সোফায় বসে অপেক্ষা করতো, তখন রাজীব ছিল এক অদৃশ্য মানব।
মানুষ প্রাণী, তবে পদার্থ বিজ্ঞানের হিসেবে বস্তুও বটে । বস্তু শক্তিতে রূপান্তর না হলে দৃশ্যমান। তাই রাজীব আহমেদও শারিরীকভাবে অদৃশ্য ছিল না । তাঁর অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটি অন্যরকম। সার্কাসের ক্লাউন চরিত্রে অভিনয় করা মানুষটি যেমন করে, রঙীন পোষাকে, মেক-আপে, আলগা লাগানো নাকের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে থাকে, রাজীব আহমেদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটি অনেকটা সেরকম।
প্রতিদিন সকালে, ব্যাগ গুছিয়ে বের হতো রাজীব, যেন তাঁর স্ত্রীর মনে হয়, সে কাজের জন্য বেরিয়ে যাচ্ছে। তারপর, হেড অফিসের তিন তলায় এসে , সেলস ডিরেক্টর ইকরাম উল্লাহর অফিসের সামনের সোফায় বসে অপেক্ষা করতো।
বিষয়টি এমন নয় যে, তাঁকে কেউ জোর করে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। টেরিটরি ম্যানেজার , তাঁকে মার্কেট থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে হেড অফিসে পাঠিয়ে দেয়। তাঁর চাকুরী থেকে অব্যাহতির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সেলস ডিরেক্টরের হাতে। তাঁর বরখাস্ত-বিষয়ক ফাইলটি ছিল ইকরাম উল্লাহর টেবিলে। এটি অনুমিত ছিল যে, যে কোন মূহুর্তে রাজীবকে ডাকা হতে পারে। কিন্তু ঠিক কখন ডাকা হবে, রাজীবের জানা ছিল না। ইকরাম উল্লাহ যদি তাঁকে ডাকেন, আর ডেকে না পান, তবে হয়তো নিজের পক্ষে সাফাই দেয়ার ন্যুনতম সুযোগটিও হারাবে রাজীব,তাই দুপুর বেলা খাবার গ্রহণের সময়টুকু বাদ দিলে, বাকী সময়টুকু ইকরাম সাহেবের কেবিনের বাইরেই অপেক্ষা করতো সে।
সকাল ন'টায় যখন ইকরাম উল্লাহ অফিসে প্রবেশ করতো, তখন সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিতো রাজীব। সন্ধ্যায় তিনি যখন অফিস থেকে বেরিয়ে যান, তখনও সে দাঁড়িয়ে যেতো সালাম দিতে। ইকরাম উল্লাহ সাহেব সাধারণত: দু'বেলাতেই সালাম গ্রহণ করতো, কারণ মুসলিম হয়ে সালাম গ্রহণ না করাটি এক পাপকার্য । কিন্তু এর চেয়ে বেশী কিছু সৌজন্য নয়। ইকরাম উল্লাহ সাহেবের ভালই জানা ছিল, তাঁর অফিসের বাইরে সোফায় অপেক্ষমান ব্যক্তিটি কে? কি কারণে এসেছে? কিন্তু মার্কেট থেকে তুলে আনা, সাময়িক বরখাস্ত বিক্রয় প্রতিনিধিকে অপেক্ষা করিয়ে রাখা তাঁর বিশেষ এক টেকনিক।
ইকরাম উল্লাহ সাহেব 'অপেক্ষা'-র এই কৌশল নিয়ে রীতিমত গর্ব করেন। বলেন, এটা তাঁর জেনুইন এক ডিসকভারি। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করে, যতটা উৎফুল্ল হয়েছিলেন, তাঁর আনন্দ যেন ঠিক ততটাই। তাঁর 'অপেক্ষা'-য় একজন শাস্তি পায়, সেই শাস্তির খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মাঝে মাঝে কোন মার্কেটে বেচা-বিক্রি কমে গেলে সেলস ডিরেক্টর, ফিল্ড লেভেলের ম্যানেজারদের ফোন করে বলে, ' দু'এক জনরে মার্কেট থেকে তুইল্যা পাঠায়া দেন। সাত দিন বইস্যা থাকুক আমার অফিসের সামনে, দেখবেন পুরা টিম সোজা হয়ে গেছে।' ফিল্ড লেভেলের ম্যানেজাররাও সেলস অফিসারদের 'অপেক্ষা'-র ভয় দেখায়। মানুষকে ডিসিপ্লিনে আনার এই প্রক্রিয়াটি , অনেকটা নরকের ভয় দেখিয়ে, মানুষকে পাপ কার্য থেকে বিরত রাখার মতো। এতো যে নরকের ভয়, তবুও মানুষ নিয়ম ভাঙ্গে। রাজীবও ভেঙ্গেছে।
ইকরাম উল্লাহ চাইলে, রাজীবের কেইসটা এক দিনে সমাধান করে দিতে পারতো। কাজে গাফিলতির জন্য, তাঁকে ডিসমিস করে দিতে পারতো , অথবা, অন্য কোন ধরণের লঘুতর শাস্তি দিয়ে, অন্য কোন মার্কেটে বদলি করে দিতে পারতো। কিন্তু ইকরাম উল্লাহ 'অপেক্ষা' করিয়ে রাখার শাস্তিটিকে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ঝুলে থাকা শাস্তির অনিশ্চয়তার মধ্যে, অফিসের সামনে দিনের পর দিন অপেক্ষা করা প্রবল এক মানসিক পীড়ণ। সবাই দেখে , সবাই জানে কারা ইকরাম সাহেবের অফিসের বাইরের সোফায় অপেক্ষা করে। সবাই করুণার দৃষ্টিতে তাকায় অপরাধীর দিকে। আহা! ইকরাম উল্লাহ সাহেবের 'অপেক্ষা'-র রিমাণ্ড চলছে। অপরাধী বিক্রয় প্রতিনিধিরা সেই সব করুণার দৃষ্টি সহন করে , কখনো মাথা নিচু করে পত্রিকা পড়ে, কখনো নার্ভাস একটা হাসি দিয়ে কারো সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে ঠিকই, কিন্তু হেড অফিসে 'অপেক্ষা'-রত বিক্রয় প্রতিনিধিদের নাম কেউ জানে না; মোটামুটি অদৃশ্য মানব তাঁরা।
পরবর্তী সময়ে রাজীবকে থানায় সোপর্দ করা হয়। মোটা লাঠি হাতে, থানার সহকারী পুলিশ ইন্সপেক্টার যখন জিজ্ঞেস করে, সে আগে থেকে সেই ম্যাডামকে চিনতো কিনা, তখন রাজীব না সূচক উত্তর প্রদান করে। পরে যখন আবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, সে কেনো হঠাৎ করে, আরিফা ম্যাডামকে চুমু খেলো, তখন রাজীব কিছুই বলে না। হাজতখানার দেয়ালে হেলান দিয়ে, রাজীব ভাবার চেষ্টা করে, সত্যি সে আরিফা ম্যাডামকে চুমু খেয়েছিলো কিনা।
ঘটনার সূত্রপাত, জুনের এক ভ্যাপসা গরমের বিকেলে। ঢাকা শহরে জুনের বিকেল মানেই যেন এক ক্লান্তি । সব কিছুই যেন অবাস্তব। মানবীয় সকল শব্দ ছাপিয়ে অবিরাম রিক্সার ক্রিং ক্রিং, গাড়ী বা বাইকের ভেঁপু, মন থেকে মানুষের চিন্তাকে আলগা করে দেয়। দেহটিকে চালিয়ে নিলেও, মন যেন আঁকা ছবির মেঘের মতোই নিশ্চল।
রাজীব আহমেদ হঠাৎ ক্লান্ত বোধ করে। ক্লান্তিটি ঠিক দেহের নয়, বরং মনের। বেশ ক'দিন ধরেই লক্ষ্যমাত্রার পেছনে অবিরাম ছুটছিল সে । একবার মনে হয়, সে তাঁর টেরিটরি ম্যানেজারকে ফোন করে, ছুটি চেয়ে নেবে। কিন্তু পরক্ষণেই উপলব্ধি হয়, মনের ক্লান্তিটি ঠিক বুঝিয়ে বলা যাবে না। ম্যানেজার সাহেব মনের ক্লান্তির কথা শুনলে হেসেই উড়িয়ে দেবেন। হয়তো, মনের ক্লান্তির মেডিক্যাল সার্টিফিকেট চেয়ে বসতে পারেন। মনের ক্লান্তি আছে, অথবা মন আছে, এমন মানুষকে অপুরুষ হিসেবেই দেখা হয় এদেশে। ম্যানেজারকে না জানিয়েই , রাজীব বাড়ী ফিরে আসে। ভাবে, দৈনিক কাজের রিপোর্টে যা হয় কিছু একটা লিখে দেবে।
শহরের এক প্রান্তে. একেবারে বেড়ী বাঁধের কাছে, দেড় কামড়া ফ্ল্যাটের বহির্গামী দরজার পিপহোলে চোখ রেখে কুসুম দেখে তাঁর স্বামী; হালকা নীল শার্টের উপরের দু'টি বোতাম খোলা। মাথার চুল উসকো-খুসকো। উজ্জ্বল শ্যামলা ত্বকে ঘাম চকচক করছে। কুসুম ভীষণ অবাক হয়। রাজীব কখনোই রাত এগারটার আগে ঘরে ফেরে না। কুসুম নি:শব্দে দরোজা খুলে, ঠোঁটে তর্জনী চেপে স্বামীকে সাবধান করে, কারণ তাঁদের একমাত্র শিশুসন্তানটি অন্য ঘরে ঘুমুচ্ছে। রাজীব সন্তর্পনে ঘরে প্রবেশ করে। ঘরটিতে আসবাব বলতে প্লাস্টিকের কভারে ঢেকে রাখা একটা সস্তা ডাইনিং টেবিল, আর টেবিলকে ঘিরে রাখা তিনটি কাঠের চেয়ার। ঘরের এক কোণে, ফ্লোরে একটা বিছানা পাতা।
এসময় কেন বাড়ীতে ফিরেছে, সে প্রশ্নের উত্তরে রাজীব কিছুই বলে না। কাপড় ছেড়ে বাথরুমে প্রবেশ করে। গোসল শেষে বেরিয়ে এসে দেখে, কুসুম চা করেছে আর প্লেটে কয়েকটা বিস্কিট। রাজীব চায়ের কাপে চুমুক দিতেই, মোবাইল ফোনটি বেজে উঠে। ডিসপ্লেতে , টেরিটরি ম্যানেজার, কামরুল হাসানের নাম দেখেই উৎকন্ঠিত হয় সে। খাটাশ একটা! উঠে গিয়ে ঘরের জনালাটি খুলে দেয়, যাতে রাস্তার গাড়ীর শব্দ ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। ফোনে কথা বলার সময়, পরিবেশে শব্দ না থাকলে, সন্দেহ করে বসবে কামরুল হাসান। তারপর সে ফোনটি রিসিভ করে। ম্যানেজারের প্রশ্নে উত্তরে, সে জানায় , সে এখন সাগর এন্টারপ্রাইজে প্রবেশ করছে।ম্যানেজারের সাথে কথা শেষ হলে, স্বামী-স্ত্রী দু'জনই চুপ করে থাকে। ম্যানেজারকে বলা মিথ্যেটি যেন কিছু সময়ের জন্য ঘরের ভেতর ঝুলতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে আবার কথা শুরু হয়।
হঠাৎ রাস্তায় একটা গাড়ীর ভেঁপুর তীব্র শব্দ শুনা যায়। কুসুম ত্রস্তে জানালাটি বন্ধ করে আসে । কিন্তু ততক্ষণে তাঁদের ছেলেটি কাঁদতে শুরু করছে। কুসুম উঠে শোবার ঘরে যায়। রাজীব শুনতে পায়, কুসুম ছেলের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। ছয়মাসের শিশুর কান্না থামানোর সবচেয়ে ভালো কৌশল হলো, মুখে স্তনের বৃন্ত গুঁজে দেয়া। কিন্তু ছেলের জন্মের পর, কুসুমের বুকের দুধ আশানুরূপ প্রবাহিত হয় নি। তাই, ফর্মূলা দুধের উপর নির্ভর করতে হয়। দুধের দাম আবার বেড়েছে! রাজীব এসে ঘরের এক কোণে পাতা বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
মাথার উপর ঘুর্ণায়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রাজীবের মনে হয়, সে যে বিবাহিত, তাঁর যে একটি পুত্র সন্তান রয়েছে, এটি যেন এক স্বপ্ন। এই তো সেদিন বন্ধুরা মিলে কলেজের মাঠে ক্রিকেট খেলছিল। উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর থেকে কুসুমের সাথে তাঁর প্রেম। কুসুম তাঁর সমবয়সী। কুসুমের পরিবার থেকে বিয়ে চাপ ছিল , তাই তড়িঘড়ি করে কোন রকম একটা চাকুরী নিয়েই, সে বিয়ে করে। ভেবেছিল, বিয়ের পর, এই চাকুরী ছেড়ে, সরকারী একটা চাকুরীর চেষ্টা করবে। তখনই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। ছোট বোন কলেজে। সংসারের দায়িত্ব এসে তাঁর কাঁধে পড়ে। তাঁর এই বিক্রয় প্রতিনিধির চাকুরীটি ছাড়া হয় না। রাজীবের মনে হয়, ঘুম ভাঙলেই সে দেখবে, বাইরে ভোরের আলো ফুটছে। সে স্বপ্ন দেখছিল রাতের।
কুসুম, রাজীবের মতো নয়। সে অপেক্ষাকৃত সচ্ছ্বল পরিবার থেকে এসেছে। ভীষণ পজিটিভ। সবকিছুতেই মানিয়ে নিতে জানে। ঢাকা শহরের নতুন জীবনের সাথে মানিয়ে নেয়াটিও , তাঁর কাছে একধরণের অ্যাডভেঞ্চার। একদিন কুসুম জানায় সে সম্ভবত: অন্ত:সত্ত্বা। আনন্দে বিহ্বল, কুসুমের চোখ ছলছল করে। রাজীব কুসুমকে জড়িয়ে ধরে। জড়িয়ে ধরাটি তাঁর আবেগের বহি:প্রকাশ ছিল না, বরং ভিন্ন এক আবেগ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা। কুসুম বুঝতেই পারে না, রাজীব এমূহুর্তে সন্তানের জন্য কতটা অপ্রস্তুত, আর কতটা সন্ত্রস্ত! অনেকবার তাঁর মনে হয়েছে, কুসুমকে বলে, এ মূহুর্তে সন্তান নিতে প্রস্তুত নয় সে। কিন্তু কুসুম আসন্ন মা হবার উল্লাসে কখনো হেসেছে, কখনো কেঁদেছে। কুসুমকে আর কিছুই বলতে পারে নি।
কুসুম ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে এসে রাজীবের পাশে শোয়। তাঁরা তাঁদের ছেলের কথা আলাপ করে। কুসুম ছেলের জন্য প্রতিমাসে সঞ্চয়ের কথা বলে। এই সময়টাতে রাজীব কোনদিনই বাসায় ফেরে না। ছেলের জন্মের পর থেকে, কুসুম ছেলের কান্না, দুধ, আর ছেলের স্বাস্থ্য নিয়ে এমন ব্যস্ত ছিল, নিবিড় হবার সুযোগই ছিল না তাঁদের। একটু নিবিড়তার সুযোগে দু'জনের দেহই জাগ্রত হলে, তাঁরা মিলিত হয়। রাজীব ভাবে, শরীর এক ধরনের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, কখন লাভার উদগীরণ হবে কেউ জানে না।
পরদিন সকালেই ম্যানেজারের জরুরী তলব। কালো একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে কামরুল হাসান কি যেন লিখছে; তাঁর কাঁচাপাকা চুল মেহেদীর রঙে লালচে বাদামী বর্ণ ধারণ করেছে। মুখের বাম দিকে লম্বা কাটা দাগ; ডাক্তারী সেলাইয়ের চিহ্ন । রাজীবকে দেখে লেখা থামান তিনি। হাতের বলপেন তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে নিয়ে নাড়াতে নাড়াতে জিজ্ঞেস করেন , গতকাল বিকেলে কোথায় ছিলেন? মুহুর্তের জন্য থমকে যায় রাজীব। পরক্ষণে সামলে নেয় সে। "প্রথমে সাগর এন্টারপ্রাইজ , তারপর..'
-- তাই!
কামরুল হাসানের মুখে যেন একটা বিদ্রুপের হাসি।
-- গতকালের কাজের রিপোর্টটা বাইর করেন?
রাজীব ব্যাগের ভেতর ডেইলী রিপোর্টটি খুঁজতে থাকে। কামরুল হাসান কাগজে কি যেন একটা লিখে। তারপর সই করে । অবশেষে ডেইলী রিপোর্টটি খুঁজে পায় রাজীব। রিপোর্টের নিচের অংশ খালি। রাজীব বলে যে, সে ভীষণ ক্লান্ত ছিল বিগত রাতে। তাই সন্ধ্যার কাজের বিবরণ লিখতে পারে নি।
-- বিয়ে তো করছেন ম্যালা আগে , এখনো টায়ার্ড হয়ে যান?
দাঁত বের করে হাসে কামরুল হাসান। দাঁতাল শুয়োরের মতো হাসি! ইংগিতটা টের পায় রাজীব। কোনঠাসা রাজীব চুপ করে থাকে।
কামরুল হাসান রাজীবের ডেইলী রিপোর্টটি অন্য একটা কাগজের সাথে স্ট্যাপল করে।
-- কাল থেকে হেড অফিসে গিয়ে অপেক্ষা করবেন। ইকরাম স্যার আপনাকে ডাকবেন।
রাজীব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কামরুল হাসানের মুখের দিকে ।
অপেক্ষা ... ইকরাম সাহেবের ডাকের জন্য অপেক্ষা। তাঁর এই তিন বছরের চাকুরী জীবনে কতবার কতজনকে এই অপেক্ষা করতে শুনেছে সে। এই অপেক্ষার অর্থ সবাই জানে। রাজীবের গলায় শুকিয়ে আসে। কামরুল হাসানের কন্ঠ শুনতে পায় সে।
-- আমার হাতে কিছু করার ছিল না। আপনার ওয়ার্ক প্ল্যান অনুযায়ী, কাল সাগর এন্টাপ্রাইজে স্বয়ং চেয়ারম্যান সাহেব হাজির ছিলেন।
কোম্পানীর চেয়ারম্যানের ঝটিকা পরিদর্শনের কথা সবাই জানে। তিনি একদা সরকারের আমলা ছিলেন। এরাশাদের আমলে বহুজাতিক কোম্পানীটি যখন অপারেশান গুটিয়ে নিচ্ছিল, তখন প্রভাব খাটিয়ে, অতি অল্পদামে, কোম্পানীর মালিক হয়ে যান। চেয়ারম্যানের বয়স এখন আশির উপর। এখন যদিও তাঁর ছেলে-মেয়েরাই সব দেখে, কিন্তু লাঠিতে ভর দিয়ে , মাঝে মাঝেই হাজির হয়ে যান মার্কেটে অথবা কোম্পানীর অন্য কোন বিভাগে। সে যে মৃত নয়, এ যেন তা প্রমাণ করার খেলা। তিনি ন্যুনতম বিচ্যুতিতে তাঁর কর্মচারীদের ফায়ার করে, ক্রমে দূর্বল হতে থাকা শরীরে যেন এক ধরণের শক্তি খুঁজে পান।
রাজীব কামরুল হাসানের মুখের দিকে তাকিয়েই থাকে। সহকর্মী আবিদের মুখটা মনের মাঝে ভেসে উঠে। কম বয়সী একটা ছেলে। খুলনায় বাড়ী। টার্গেটের চাপে বেসামাল হয়ে পড়েছিল। তীর্যক বাক্যে অতিষ্ঠ হয়ে , কলার চেপে ধরেছিল ম্যানেজারের। তাই অপেক্ষা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ। শুকনো মুখ করে বসে থাকত। পরিচিত কাউকে দেখলে অপ্রস্তত মুখে হাসত। চাকুরী নেই । মেসে সিট ভাড়া বাকী। মেসে যেতে পারে না। বাড়ীও যেতে পারে না, মার্কেটে দেনা-পাওনার হিসেব শূণ্য না হলে, মামলার ভয়। কিন্তু 'অপেক্ষা' যেন আর শেষ হয় না। শেষ ক'দিন অফিসের ছাদে রাত কাটিয়েছিল সে ।
-- আপনাকে বরখাস্ত না করলে, আমি নিজেই বরখাস্ত হয়ে যেতাম।
ম্যানেজারের কথা রাজীবের কানে প্রবেশ করে না। আবিদের কন্ঠ শুনতে পায় সে। 'রাজীব ভাই, রিসিপশানে এমনে বাইস্যা থাকনের চে, জেল খাটা সহজ। একেকবার মনে হইতো, হেড অফিসের কোন সুন্দরীর ঠোঁটে একটা চুমা দিয়া দেই। তাইলে এরা হয়তো আমারে পুলিশে, নাইলে পাগলা গারদে দিয়া দিব। অন্ততঃ দিনের পর দিন এইভাবে অপেক্ষা তো আর করতে হইবো না।'
-- অনেক সময় ম্যানেজম্যান্ট অল্প শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেয়। দোয়া-দরুদ পড়েন।
কামরুল হাসান সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে। চাকুরীর ট্রেনিং শুরু হবার প্রথম দিনে, সেলস ডিরেক্টর ইকরাম উল্লাহর ভাষণের অংশবিশেষ মনে পড়ে রাজীবের। 'ডারউইনের বিবর্তনবাদের নাম শুনেছেন? সেখানে একটা কথা আছে, যোগ্যতমের জয়। এই প্রফেশানে আপনাকে প্রতিদিন যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। প্রতিটি দিনই একটা ভিন্ন দিন। একটি দিনের সাফল্য, পরবর্তী দিনের সাফল্যের নিশ্চয়তা দেয় না। প্রতিদিন আপনাকে আলাদা আলাদা ভাবে জয়লাভ করতে হবে। ফেইলিয়র ইজ নট এন অপশান।'
-- আপনি সন্ধ্যায় মার্কেটে যেতে পারবেন না। আমাকে আগে থেকে জানাবেন তো!
ভরাট কন্ঠ ইকরাম উল্লাহর। বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি মুসার নাম শুনেছেন? সমুদ্রপথে পথে স্পেনে পৌঁছার পর সেনাপতি মুসা তার নৌকাগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিল। কেন জানেন? সৈন্যদের যাতে আর পালিয়ে যাবার পথ খোলা না থাকে। বাঁচতে হলে , প্রতিটি সৈন্যকে যুদ্ধ করে বাঁচতে হবে। সেলসম্যানসীপ অনেকটা দ্বীপে পৌঁছে নৌকা পুড়িয়ে দেবার মতো। ফিরে যাবার পথ বন্ধ। লিভ অর ডাই।
-- আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। আমারও সংসার আছে।
চোখে ভাসে, ছোট কাঁথার বিছানায়, ছোট এক মশারীর নিচে, ছোট এক বালিশে মাথা দিয়ে,ছোট অনিক ঘুমিয়ে আছে। ছোট দু'টি হাত মুষ্টিবদ্ধ । কপালে কাজলের টিপ। মাঝে মাঝে মুখ টিপে টিপে হাসছে, ঘুুুমের মাঝেই। দুধ গুলছে কুসুম। তার হাতে কাঁচের চুরির শব্দ। বাকী সব শুনশান।
-- এখন বাড়ী যান। কালকে থেকে হেড অফিসে অপেক্ষা করবেন।
সেলস অফিস থেকেই বেরিয়েই রাজীবের মনে হয়, এই অগ্র-পশ্চাতহীন ঢাকা শহরে, অজস্র দালান-কোঠা, কিন্তু তাঁর যাবার কোন স্থান নেই। সে চাকুরী থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত। তাঁর বেতন স্থগিত, তাঁর কর্মক্ষেত্র নেই। টেকনিক্যালী সে শহরের শেষ প্রান্তে তাঁর ভাড়া করা ফ্ল্যাটে ফিরে যেতে পারে, যেখানে তাঁর স্ত্রী-শিশুসন্তান রয়েছে। কিন্তু অসময়ে বাড়ী ফিরে গেলে,কুসুমকে সে কি বলবে? সে ফুটপাথ ধরে হাঁটে। কোন গন্তব্য নেই। সে প্রথম বারের মতো অনুভব করে, কেউ যেন তাঁকে লক্ষ্য করছে না। তাঁর চাকুরী চলে গেছে, এমাসে সংসার কেমন করে চলবে , তা সে জানে না, অথচ শহরের কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
হাঁটতে হাঁটতে ধানমন্ডী পার্কে প্রবেশ করে। রেইনট্রি গাছের ছায়ায় একটা বেঞ্চীতে ব্যাগ রেখে, পাশেই বসে। সামনেই লেকের সবুজ জল। জলের উপর আকাশের ছায়া। এক ঝাঁক ডানকিনে মাছ হা করে বাতাস নিচ্ছে জলের উপরিতলে । হঠাৎ একটা বড় মাছ লেকের পানিতে ঘাই তুলে হারিয়ে যায়, ঢেউ ছড়িয়ে জলের উপরিভাগে। একটা ফড়িং জলের উপর দিয়ে উড়ে যায়। রাজীবের মনে হয়, লেকের মাছ কিংবা উড়ে চলা ফড়িং-এর জীবন তাঁর জীবনের চেয়ে অনেক বেশী সফল।
তীব্র মেন্টাল শক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শরীরের নিজস্ব মেকানিজম আছে। রাজীব ঘন্টা দুই পর অনুভব করে, তাঁর ঘোর লাগা ভাবটি কেটে গেছে। মনে মনে সে এই অনিশ্চত চক্রব্যুহ থেকে বেরিয়ে আসার একটা ছক কাটে। সিদ্ধান্ত নেয়, আপাতত কুসুমকে কিছুই বলবে না । প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে আসবে বাড়ী থেকে, যেন কিছুই ঘটে নি। তারপর হেড অফিসে গিয়ে, সেলস ডিরেক্টর ইকরাম উল্লাহর ডাকের জন্য অপেক্ষা করবে। সন্ধ্যায় পার্কের বেঞ্চীতে হরিপদ কেরানীর মতো দশটা নাগাদ বসে থেকে, রাত এগারটায় বাড়ী ফিরবে। ইকরাম উল্লাহ যদি তাঁকে লঘু শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেয়, তবে কুসুমকে বরখাস্ত হবার খবর সে কখনোই বলবে না। আর , ইকরাম উল্লাহ যদি তাঁকে অব্যাহতি দেয়, তবে কুসুমকে কি বলবে, তা তখন দেখা যাবে।
সে অনুমান করে, তাঁকে হয়তো সপ্তাহখানেক হেড অফিসে ইকরাম উল্লাহর অফিসের সামনে অপেক্ষা করতে হবে। এই সাতদিনের অজ্ঞাতবাসে, যে জরুরী কাজগুলো করতে হবে, তাঁর একটা তালিকা করে ফেলে মনে মনে। বাড়ীতে টাকা পাঠাতে হবে। আজ মাসের শেষ দিন। সে আবার হেঁটে হেঁটে তাঁর সেলস অফিসের পাশেই সোনালী ব্যাংকের শাখায় যায়। গ্রামের বাড়ীতে মায়ের কাছে টাকা পাঠায়। তারপর একাউন্ট নিংড়ে সব টাকা তুলে আবিষ্কার করে, বাড়ী ভাড়া পরিশোধ করার জন্য যথেষ্ট টাকা নেই। আর হাজার খানেক টাকা হলেই এমাসের ভাড়াটি পরিশোধ করতে পারে। কিন্তু রাজীব কখনো টাকা ধার করে নি। কি করবে রাজীব ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। রাজীব হাঁটতে হাঁটতে আবার পার্কে ফিরে আসে। বিকেলে ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়ে গেলে, সে কলা-বিস্কিট-পাউরুটি চা কিনে খায়। তারপর, এদিক-ওদিক সময় কাটিয়ে রাত এগারটায় বাড়ী ফিরে। গোসল করে ভাত খায়। কুসুমের সাথে আটপৌড়ে কিছু কথা হয়। তারপর তাঁরা শুতে যায়। কিন্তু রাজীব ঘুমায় না। যখন নিশ্চিত হয় কুসুম ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন সে বিছানা ছেড়ে উঠে। সন্তর্পনে বাইরের ঘরটিতে প্রবেশ করে। নি:শব্দে কাঠের আলামারীর দরজা খুলে, কুসুমের ভ্যানিটি ব্যাগটি হাতে নেয়। রাজীব জানে, সংসার খরচ থেকে কিছু বাঁচিয়ে কুসুম ওখানেই রাখে। সে ব্যাগ থেকে কিছু টাকা সরিয়ে নেয়। 'কোন জিনিস না বলে নেয়ার নাম চুরি', সে মরহুম শিক্ষক পিতার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।
পরদিন সকালে , যথারীতি পোষাক পরে, নাস্তা করে, ব্যাগ গুছিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময়, বাড়ীওয়ালার ফ্ল্যাটে যায় ভাড়া দিতে। ভাড়া দিতে এলে এরা বেশ খাতির যত্ন করে। বাড়ীওয়ালার বউ বেশ যত্ন সহকারে ঘরের ভেতর নিয়ে বসায়। কখনো মন ভালো থাকলে, মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে। আজ মনে হয় মন ভালো নেই। মুখ বেজার করে টাকা গুণে বাড়ীওয়ালা। একবার গুণতে ভুল হয়, তাই আবার গুণে।
কোন মাসের ভাড়া না দিতে পারলে, বোধ হয় এরা - বোধ হয় না নিশ্চিত - বউ-বাচ্চা, লেপ-তোষক সহ বাসা থেকে বের করে দেবে। জমিদারী আমলে খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে জমিদার খাজনা-খেলাপী প্রজাকে বরকন্দাজ দিয়ে ধরে আনত, কয়েদ করে রাখতো, নির্যাতন চালাতো। এরা তা করবে না। ভাড়াটে ঝামেলা করলে, প্রথমে পাড়ার পান্ডাদের ডাকবে, এতে কাজ না হলে পুলিশ ডাকবে। কেমন একটা জমিদারী ব্যবস্থা আজো চালু আছে! প্রতিটি বাড়ী এক একটা তালুক। জমিদার নেই,জমিদারী আইন নেই, পাইক বরকান্দাজ নেই, তবু সামন্ত ব্যবস্থা ঠিকই চালু আছে !
টাকা গুণা শেষ হয় বাড়ীওয়ালার। খানিকটা সন্তুষ্ট মনে হয় তাকে। সে চোখ তুলে তাকায় রাজীবের দিকে। যার অর্থ, তুমি এখন চাইলে যেতে পার।
তারপর হেড অফিসের দিকে রওনা দেয় রাজীব।আজ থেকে তাঁর অপেক্ষার শুরু।
ইকরাম উল্লাহ সাহেবের কেবিনের দরজার পাশে, একটা টুল পেতে বসে থাকে একজন পিয়ন। ফিরোজা রঙের ইউনিফর্মের বুকপকেটে আটকানো নেমপ্লেট থেকে জানা যায় পিয়নের নাম একাব্বর মিয়া। পিয়ন একাব্বর মিয়া ঢুলু ঢুলু চোখে, কটন বাড দিয়ে কান চুলকায়। আর সংকুচিত চোখে তাঁকে অবলোকন করে। রাজীবের বয়স, পোষাক আর হাতে থাকা সেলসম্যানের ব্যাগ দেখে, একাব্বর মিয়া আন্দাজ করে ফেলে, রাজীব কেন এখানে এসেছে।
-- সোফায় বইস্যা ওযেট করেন। স্যার আপনারে ডাকবো।
মাছে পচন ধরলে, গন্ধ লুকানো বড়ই কঠিন! রাজীব মনে মনে ভাবে।
কিন্তু ইকরাম উল্লাহ সাহেব কেমন করে জানবে, রাজীব তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে? রাজীব এই প্রশ্নটি উত্থাপন করতেই, একাব্বর মিয়া সবজান্তার হাসি দেয়।
-- ইকরfম উল্লাহ স্যারের মাথার উপরেও চউখ আছে। অহন আপনের কাম হইলো, স্যাররে দেখলেই, উইঠ্যা দাড়াইয়া সালাম দেয়া। সময় আইলে ঠিকই ডাইক্যা নিবো।
ইকরাম উল্লাহর কেবিনের কাঁচের দেয়ালের গাঁ ঘেষে নব্বই ডিগ্রী কোণ করে রাখা, দু'টি নরম তুলতুলে সোফা। দুই সোফার মাঝখানে একটা চৌকোণ কাঁচের অ্যাকোরিয়াম। সামনে একটা সেন্টার টেবিল। টেবিলের উপর সংবাদপত্র আর কিছু ম্যাগাজিন। রাজীব সোফায় গিয়ে বসে।
এয়ার কন্ডিশান্ড কক্ষের শীতলতায়, নরম সোফায় বসে অপেক্ষার মাঝে শারিরীক কোন পীড়ণ নেই। বিষয়টি হাজতখাটা বন্দীত্বের মতো না হলেও, অচিরেই রাজীব টের পায়, তাঁর সময় যেন থমকে গেছে। ছেলেবেলায় পরিবারের সবাই মিলে লোকাল ট্রেনে নানাবাড়ী বেড়াতে যেতো তাঁরা। ট্রেন কোন কোন ষ্টেশানে অনন্তকালের মতো থেমে যেতো। রাজীবের ভীষণ অস্থির লাগতো। তারপর আবার ট্রেন চলতে শুরু করলে, রাজীব উৎসুক চোখে তাকিয়ে দেখতো ঘুর্ণায়মান ধানক্ষেত, টেলিগ্রাফের তারে বসে থাকা ফিঙ্গে, লাল ফুলে ঢাকা শিমূলের বৃক্ষ। রাজীবের মনে হতে থাকে তাঁর রেলগাড়ীটি লোকাল ট্রেনের মতো কোন এক ষ্টেশানে থমকে আছে। নিশ্চলতা মানে মৃত্যু। সে হাঁসফাঁস করে।
অপেক্ষার ঘন্টা দুই অতিবাহিত হতেই , সে ভাবতে শুরু করে, কর্ম আর কর্মহীন অপেক্ষার মাঝে কোনটি কঠিনতর। সে থমকে যাওয়া সময়ের সাথে একধরনের মানসিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। সিদ্ধান্ত নেয়, প্রতিদিন সে সেন্টার টেবিলে রাখা দৈনিক সংবাদ পত্রিকাটি, প্রথম অক্ষর থেকে শেষ অক্ষর পর্যন্ত পড়বে। রাজনীতি, খেলাধূলা, বিজ্ঞাপন থেকে, শোক সংবাদ, সব। এ যেন থমকে যাওয়া সময়ের সাথে এক দাঁড়িয়াবান্ধা খেলা।
সংবাদপত্রের ছোট ছোট অক্ষর পড়তে পড়তে যখন চোখ ব্যথা করে, তখন সংবাদপত্র থেকে চোখ তুলে, অ্যাকোয়ারিয়োমের গোল্ডফীশগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
গোল্ডফীশের স্মৃতি খুব ক্ষণস্থায়ী। একোয়ারিয়ামের এমাথা থেকে ওমাথায় যেতে, গোল্ডফীশ তাঁর সব স্মৃতি খুঁইয়ে ফেলে। মানুষ চিরকাল স্মৃতির কারাগারে বন্দী। গোল্ডফীশের সে কারাগার নেই।
অ্যাকোয়ারিয়ামের সঞ্চরণশীল গোল্ডফীশের দিকে তাকিয়ে থেকে , প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করে, সে ধীরে ধীরে ভাবুক মানুষে রূপান্তরিত হচ্ছে। ইতিপূর্বে, এমনভাবে সে কখনোই ভাবে নি। ভাবনার স্রোত তাঁকে মূল নদী থেকে মাঝে মাঝেই শাখা-প্রশাখায় প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে। মাঝেই মাঝেই সে স্ত্রী, পুত্র, সংসার এইসব রূঢ় বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর সহসাই তাঁর ভাবনা মূল স্রোতে ফিরে আসতে পারছে না।
সন্ধ্যায় ইকরাম উল্লাহ সাহেবের অফিস শেষ হলে, সে বেরিয়ে আসে। সেন্ট্রাল এসির শীতলতার বলয় থেকে বেরিয়ে এসেই, গরমের হলকা লাগে শরীরে। হাঁটতে হাঁটতে আবার লেকের পারে , একটা বেঞ্চীতে গিয়ে বসে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাদামওয়ালার কাছ থেকে বাদাম কিনে, প্রথম বাদামটি ভাঙতেই , সে দেখে তরুণ বয়সের একজন তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
ছেলেটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অবশেষে চিনতে পারে। ছেলেটির নাম আমীরুল। রাজীব আর আমীরুলের বাড়ী একই গ্রামে। অভ্যন্তরে কৃষ্ণ মেঘের মতো বিষাদ ছড়িয়ে পরলেও জোর করে হাসার চেষ্টা করে রাজীব। এক গাদা মিথ্যে বলতে হবে এখন।
-- আপনে তো বাড়ীত যান না বললেই চলে।
আমীরুল বেঞ্চীতে বসে পড়ে। 'না, সময় কোথায়? ছুটি নাই। এই এক প্রবলেম।' রাজীব এমন ভাবে বলে যেন ছুটি না পাওয়াটাই তার চাকুরীর একমাÎ সমস্যা। নিজেকে প্রবঞ্চক মনে হয় রাজীবের।
-- ভাল চাকুরীর ভাল দায়িত্ব।
জ্ঞাণীর মতো করে বলে আমীরুল। শুনে পিত্তি জ্বলে যায় তাঁর। মনে হয়, পোদপাকা ছোকরার মাথার পেছনে চটাস করে এখনই একটা চাটি মেরে বসবে! মনে মনে বলে ,'বেটা ছাগল! ভাল চাকুরী না। বাল।' বাদামের ঠোঙ্গাটি এগিয়ে দেয় আমীরুলের দিকে।'নেও, বাদাম খাও।'
আমীরুল বাদামের খোঁসা ভাঙে , শব্দ হয়।
-আপনাদের ঔখানে লোক নেয় না রাজীব ভাই? মামা-চাচা ছাড়া চাকুরী হয় না এই দেশে। আর আমার তো সার্টিফিকেটে হুজুরের গন্ধ।
বিষন্ন কণ্ঠ আমীরুলের। রাজীব বাদামের খোসা ভাঙতে গিয়েও ভাঙে না। ছেলেটির মুখের দিকে তাকায়। লম্বাটে শুকনো মুখ, চোখ দু'টিতে ক্লান্তির ছায়া। আগে মাদ্রাসায় পড়ার সময় দাঁড়ি ছিল মুখে, পাতলা পাটের আঁশের মত। এখন কেটে ফেলেছে। হয়তো চাকুরী পাচ্ছিল না, তাই। আমীরুল যেদিন কামিল পাশ করে, সেদিন তাঁর বাবা খাসি জবাই করে। ঘটনাচক্রে রাজীবও সে দাওয়াতের শরীক হয়ে যায়। আমীরুলের বাবা ছল ছল চোখে ধরা গলায় বলেছিল, 'আপনেরা আমার পোলাডার জন্য দোয়া কইরেন। এর দাদার ইচ্ছে ছিল তাঁর নাতি যেন কামেল পাশ করে। আল্লাহ তাঁর ইচ্ছে পূরণ করছেন।'
আকাশে কয়েক টুকরো কালো মেঘ। আমীরুলের মাথার উপর দিয়ে একটা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স দেখা যায়, সামনের রাস্তায় কুঁড়ি পঁচিশটা বিভিন্ন মডেলের পালিশ করা গাড়ী। আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সফেদ পাঞ্জাবী আর টুপি পড়া বেশ কিছু লোক।
হঠাৎ রাজীবের মনে হয় , একটা সাইকেলে করে আমীরুল এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ীটির দিকে। সাইকেলের ক্যারিয়ারে একটা ব্যাগ। আমীরুল এগিয়ে যায়। মাথায় টুপি, তার মুখের ফিনফিনে দাঁড়ি বাতাসে মৃদু কাঁপছে। বাড়ীর সামনের লোকেদের ভীড়ের মাঝে ঢুকে যায় সাইকেল। আর সহসাই বিকট শব্দ। আগুনের ফুলকি। আর্তনাদ হাহাকার আর লোকজনের ছুটে যাওয়ার পদশব্দ। নাড়ি-ভুঁড়ি আর রক্ত। আর হরেক রকম জুতোর ছড়াছড়ি পিচঢালা রাজপথে।
রাজীব ভাবে, সে কি চাকুরী হারিয়ে অপ্রকৃতস্থ হয়ে যাচ্ছে?
ঢাকা শহর যেন বিরাট এক গর্ত। প্রতিদিন তাল সামলাতে না পেরে, সারাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ যেন গড়িয়ে গড়িয়ে জমা হচ্ছে এই শহরে। শেকড়বিহীন এইসব মানুষের জীবনের সাথে, ঢাকার এই সুসজ্জিত গাড়ী-বাড়ীর মানুষগুলোর যেন কোন মিল নেই। রাজীব বা আমীরুল যেন শেকলবিহীন দাস। মাদ্রাসায় পড়েছে বলে, দাঁড়ি রাখার অপরাধে তাঁর চাকুরী হচ্ছে না বলে, আজ আমীরুল যদি বেহেস্তের স্বপ্ন দেখে, নাম লেখায় আত্মঘাতী জঙ্গীর দলে, তবে দায়িত্ব কি কেবল আমীরুলের?
গতকালের পর থেকে প্রথম বারের মতো সত্যিকারের আগ্রহ জাগে তাঁর ভেতর, 'তুমি কিছু কর না এখন?' আমীরুল ফুঁ দিয়ে বাদামের দানা পরিষ্কার করে।
-- দুই বাসায় ছাত্র পড়াই। থাকা খাওয়ার খরচটা উঠে যায়। আপনার অফিসে ঢুকাইয়া দেওন যায় না, রাজীব ভাই।
'আমাদের ওখানে তো লোক নেয়া বন্ধ আপাততঃ’' কথাটা বলেই রাজীবের হাসি পায়। মনে হয় হো হো করে হেসে ফেলবে। চাকুরী খুইয়েছে সে । এবং অত্যন্ত বাজে ভাবে। অনিশ্চয়তার ছুরি তাঁর গলার উপর। তবু অভিনয় করে যেতে হবে তাঁকে। মরে গেলেও সে বলতে পারবে না, 'দেখ আমীরুল, আমার চাকুরীটা চলে গেছে।' তাঁকে অভিনয় করে যেতে হবে,' সে ভাল আছে। তাঁর বউ ভালো আছে। তাঁর ছেলে ভাল আছে। সুখী তাঁদের পরিবার। রাজীবের মনে হয় কোনটি আসলে বেশী কঠিন, পড়ে যাওয়া, নাকি পড়ে যাবার পর ব্যাথা না পাওয়ার অভিনয় করে যাওয়া?
বিষন্ন মনে হয় না আমীরুলকে। বরং নির্বিকার ভাবলেশহীন একটা কণ্ঠ।
-- লেখা-পড়া না করলেই ভালো হইতো , রাজীব ভাই। পালের না হই , হালের তো হইতাম। কামিল পাশ কইরা তো আর লাঙ্গলও ধরতে পারি না। বাড়ীতও ফিরতে পারি না।
কথা আর বেশী দূর এগোয় না। আমীরুল টিউশানী আছে বলে বিদায় নেয়।
রাজীব কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর এদিক ওদিক ঘুরে। রাত দশটায় বাড়ীর দিকে রওনা দেয়। সিঁড়ি ভেঙে বাড়ীর দরজায় বেল বাজাতে যাবে, তখনই ছেলের গুড়া দুধের কথা মনে পড়ে। মানিব্যাগ খুলে টাকা গুণে। প্রয়োজনের চেয়ে একশ' টাকা কম। দুধ ছাড়াই ঘরে ফিরবে কিনা ভাবে একবার। রাগ করবে কুসুম। রাজীব জানে ,দুধ এখনো ফুরায় নি কৌটার। ভুলে যায় বলে , বেশ আগে থেকেই তাগাদা দেয় কুসুম। গলার মধ্যে একটা দলা আটকে যায় ,চিৎকার করতে ইচ্ছে করে রাজীবের। সিঁড়িতে লাথি মারতে ইচ্ছে করে তাঁর। কিন্তু সামলে নেয়। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। গলির মুদি দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। সোনার বাংলা ষ্টোর। পেট মোটা হোঁৎকা একটা লোক কাউন্টারে বসে আছে। ফারুক নামের কর্মচারী ছেলেটা অন্য দিকে ফিরে ডাল মাপছে। রাজীব দুধের কৌটার দিকে আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ করে। 'অই কৌটাটা দেন তো ভাই।'
ফারুক তাক থেকে দুধের কৌটা নামায়। ছেঁড়া একটা ন্যাকড়া দিয়ে কৌটা মুছে। রাজীব ঢোঁক গিলে , গলা ভেজায়। প্যাকেট করে দিতে বলে।
ফারুক নাইলনের জালি ব্যাগে কৌটা ভরে কাউন্টারে এনে রাখে।
রাজীব পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে। তারপর ছোট একটা অভিনয় করে। ভাবখানা এমন যে, বাড়ী থেকে পর্যাপ্ত টাকা নিতে ভুলে গেছে সে।
কাউন্টারের পেছন থেকে মোটা লোকটা সাবধানী দৃষ্টিতে তাকায় । দুই ঠোঁটের ফাঁকে ম্যাচের শলাকা। ফারুক কিছু বলে না, মালিকের দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্ততঃ পাঁচ সেকেন্ড কিছু বলে না লোকটা। রাজীবকে সে মুখ চেনা চেনে। হঠাৎ ঠোঁট থেকে ম্যাচের কাঠি ফেলে দিয়ে হেসে রাজীবের দিকে তাকায়।
-ঠিক আছে, বাইচ্চার দুধতো, নিয়া যান। কাইল বাকী টাকা দিয়া যাইয়েন।
রাজীব দোকান মালিকের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ , তারপর বাড়ীর দিকে হাঁটে । ভাবে, ক'দিন এই রাস্তাটি পরিহার করে চলতে হবে। এ কেমন ফন্দী-ফিকির করে বেঁচে থাকা! এমন সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। শহরের মানুষ দেখে না রাজীব কাঁদছে।
হাজতখানার দেয়ালে হেলান দিয়ে, প্রথম দিনের ঘটনাগুলোর মনে করতে পারলেও, তারপরের কয়েকটি দিনে, ঠিক কি ঘটেছিল, কোন ক্রমে ঘটেছিল, তা মনে করতে পারে না রাজীব । সম্ভবত: মনে রাখার মতো তেমন কিছুই ঘটেনি। সেই একই পত্রিকা, সেই একই সোফা আর সোফার পাশে অ্যাকোরিয়ামের সঞ্চরণশীল গোল্ডফীশ। এমনকি পত্রিকার সংবাদগুলোও ছিল তাৎপর্যহীন- রাজনৈতিক কাঁদা ছুঁড়া-ছুঁড়ি , খুন-দূর্ঘটনা, নায়ক-নায়িকাদের জীবন যাপনের ট্রিভিয়াতে পূর্ণ। সাধারণের বাইরে কিছু নয়। তবে এক সন্ধ্যায়, মরিয়া হয়ে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকা পরিবারটির কথা মনে পড়ে। এতসব হুজ্জতের মাঝেও, সেই মহিলার কন্ঠস্বর ঠিক শুনতে পায় সে। 'আমরা ভিক্ষুক না। আমরা আসলেই বিপদে পড়ছি!'
অপেক্ষার তৃতীয় কি চতুর্থদিনে, এক বোরিং বিকেলে, মোবাইলের কন্টাক্ট লিষ্ট স্ক্রল করতে করতে, তাঁর বন্ধু শহীদের নাম ও ফোন নাম্বার দেখে রাজীবের চকিতে মনে পড়ে যায়, বছর চারেক আগে শহীদ তাঁর কাছ থেকে পাঁচশ' টাকা ধার নিয়েছিল। আর ফেরত দেয় নি। শহীদ তাঁর কলেজ জীবনের বন্ধু। একই হোষ্টেলে থাকতো। এখন রাজউক ভবনে চাকুরী করে। বহুদিন কোন যোগাযোগ নেই। হোস্টেলে থাকার সময়, বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে গাঁজা খেতো। আর টাকা ফেরত দিতো না। রাজীব ফোন করে, শহীদের সাথে দেখা করতে চায়। শহীদ তাঁকে ঠিকানা দিয়ে , শুক্রাবাদে তাঁর বাসায় যেতে বলে। রাজীব যে তাঁর কাছে এখনো পাঁচশ' টাকা পায়, তা হয়তো শহীদের মনেও নেই। রাজীব ভাবে সুযোগ বুঝে সে টাকাটা চাইবে।
শহীদের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেই রাজীব টের পায়, শহীদ আর আগের শহীদ নেই। তিন বেডরুমের গোছানো ফ্ল্যাট। জানালার পর্দা, সোফা, ডাইনিং টেবিল, সবকিছুর মাঝেই যেন এক স্বাচ্ছন্দ্যের ছাপ। রাজীব অনুমান করে রাজউক ভবনের কোথাও শহীদ আলাদীনের চেরাগ খুঁজে পেয়েছে। শহীদ সম্প্রতি বিয়ে করেছে। শহীদ জানায় , সে রাজীবকে দাওয়াত দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ফোন হারিয়ে ফেলায়, রাজীবের ফোন নাম্বার খুঁজে পায় নি। শহীদ এখন দাঁড়ি রেখেছে। কপালে দাগ দেখে ধারণা করা যায়, নামাজও পড়ে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায়ের জন্য, শহীদের কারণের কোন স্বল্পতা নেই আর।
কিছুক্ষণ পর হিজাব পরিহিত, পুতুলের মতো দেখতে, শহীদের কিউট স্ত্রী এসে সালাম দেয়। তারপর শহীদ তাঁকে রাতের খাবার খেয়ে যেতে বলে। শহীদ ও তাঁর স্ত্রী তাঁকে সাদরে আপ্যায়ন করে। যত্ন করে বিভিন্ন পদ এগিয়ে দেয় শহীদের স্ত্রী। কিন্তু শহীদের আতিথেয়তা সে গ্রহণ করে বিষন্ন মনে। রাতের খাবার খেতে খেতে, রাজীবের মনে পরাজয়ের গ্লানি এসে ভর করে। রাজীব সিদ্ধান্ত নেয়, শহীদের কাছে সে তাঁর বিপর্যয়ের কথা বলবে না, টাকাও চাইবে না। এবং খুব সম্ভব, শহীদের সাথে আর কোনদিন যোগযোগও করবে না আর।
শহীদ কখনোই মনোযোগী ছাত্র ছিল না। রাজীব জানতো শহীদের এক মামা রাজউক ভবনের ইঞ্জিনিয়ার। সেই সম্ভবত: শহীদকে চাকুরীতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। শহীদের বাসা থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে , রাজীবের মনে হয়, সৃষ্টিকর্তা কেমন করে দৈবচয়নের মাধ্যমে মানুষের জন্ম নির্ধারণ করে দেয়? এই দৈবচয়েনের পেছনে সৃষ্টিকর্তার কি লজিক আছে, কে জানে? ইদানিং সৃষ্টিকর্তার সাথে এক ধরণের বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে।
গলি দিয়ে কিছুটা হেঁটে মিরপুর রোড থেকে বাস ধরবে রাজীব । রাত প্রায় দশটা । রাতে কম আলোর গলিপথ ছিনতাইয়ের জন্য আদর্শ জায়গা। তাঁর গা ছম ছম করে। 'এই যে ভাই' পেছন থেকে নারী কণ্ঠের আওয়াজে সে চমকে উঠে। পেছন ফিরে দেখে , বোরখা পড়া এক মহিলা ,কোলে দু'তিন বছরের শিশু। হাত দুয়েক দূরে একটা লোক, পরণে পরিষ্কার পায়জামা-পাঞ্জাবী, পায়ে চামড়ার জুতা, মুখে সুন্নতের দাঁড়ি, হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ। তিনজনই তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখছে। 'ভাই আমাদের বাড়ী ফরিদপুর , গতকাইল ঢাকায় আসছি, ডাক্তার দেখাইতে। আইজ ফেরত যাওনের কথা। কিন্তু রাস্তায় পকেটমার হইয়া গ্যাছে।’ মহিলাটি করুণ কণ্ঠে বলে যেতে থাকে। স্বামীর পাঞ্জাবীর আস্তিন তুলে, কাটা পকেটের চিহ্ন দেখায়।
'আপনাদের বাড়ী ফরিদপুরের কোন থানায়?' কেন যেন আজ , তাঁর এই পরিবারটি সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হয়।
-- বোয়ালমারী
'কোন বাসে আসছেন ঢাকায়?'
-- আনন্দ পরিবহন
রাজীব আর প্রশ্ন করে না। ভিক্ষায় নামার আগে এ ধরণের কিছু প্রশ্নের উত্তর তো এদের জানতেই হয়। হয়তো এরা সত্যি বোয়ালমারী থেকে এসেছে । হয়তো এরা পদ্মা পারের মানুষ , নদী এদের সব কেড়ে নিয়েছে, ভিটে, ফসলের জমি, ফলের গাছ, মাছের পুকুর, আত্মসম্মান সবকিছু। অন্যের বাড়ী কাজ করে খেতে এরা অভ্যস্ত নয়। দিন মুজুরের কিংবা রিক্সা চালানোর কাজ এদের কাছে অপমানের। হয়তোবা এ ধরণের প্রতারণা থেকে রোজগার বেশী। হয়তো বা সত্যি সত্যি এদের পকেটমার হয়েছে। নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই।
এরকম অসংখ্য মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরছে, এই শহরের কোণে কোণে । কেউবা প্রেসক্রিপশান হাতে ছেলের জন্য, রক্তের চাহিদার কাগজ হাতে মায়ের জন্য, এক্সরে রিপোর্ট আর ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতে নিজের জন্য সাহায্য প্রার্থণা করছে। বোঝার কোন উপায় নেই , সত্যি এরা বিপদগ্রস্ত কিনা। রাজীবের হঠাৎ মনে হয়, এদের সকলেরই হয়তো নিজস্ব কাহিনী আছে, প্রতারণার পেছনে নিজস্ব কোন যুক্তি আছে। এদের কেউ কেউ হয়তো চাকুরী খুঁইয়ে রাস্তায় নেমেছে ,অনেকটা ঠিক তাঁর মত। নিশ্চিত তাঁর চেয়েও কোন করুণ কোন গল্প।
পরিবারটির পোষাক, কথার ধরণ আর ক্লান্ত মুখ দেখে গল্পটি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় রাজীবের। কিন্তু সে জানে অন্ততঃ নিরানব্বই ভাগ সম্ভাবনা গল্পটি মিথ্যা হওয়ার। তবু এই পরিবারটির জন্য বিষন্ন বোধ করে। সে শিশুটির দিকে তাকায়। তাঁর নিজের শিশুসন্তানের কথা মনে পড়ে। এর আগে এমন সহমর্মী হয়ে কখনো ভাবে নি। হয়তো সে চাকুরী হারিয়েছে বলে। তাঁর বর্তমান অবস্থা যেন একটা সুইচ গেট খুলে দিয়েছে, সে তাঁর ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
কম আলোতে তাঁর চোখ ছল ছল করে। কিছু না বলেই সে ঘুরে হাঁটা শুরু করে।
'ভাই আমরা ভিক্ষুক না। আসলেই বিপদে পড়ছি। বাচ্চাডারে সারাদিন কিছু খাওয়াইতে পারি নাই।' মহিলা যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে ফিরে তাকায় না । বাড়ী ফিরে, বিছানায় শুতে গিয়েও মহিলার করুণ কণ্ঠস্বরটি শুনতে পায়, ' ভাই আমরা ভিক্ষুক না!'
অপেক্ষার চতুর্থ কি পঞ্চম দিনে, ইকরাম উল্লাহ সাহেব অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়, তাঁর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। রাজীবের মনে হয়, হয়তো তাঁর ডাকের সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু পরদিন হেড অফিসের তিন তলায় এসে দেখে, ইকরাম উল্লাহ সাহেবের কেবিন অন্ধকার। অন্যদিন, পিয়ন একাব্বর মিয়া কেবিনের সামনে বসে ঝিঁমাতো। আজ সেও অনুপস্থিত। রিসিপশানে একটু খোঁজ নিয়ে রাজীব জানতে পারে, ইকরাম উল্লাহ সাহেব মালয়েশিয়া গেছেন; ওখানে তাঁর ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ছেলেকে কুয়ালালুমপুরে সেটেল করেই ফিরবেন। ঠিক কবে ফিরবেন, এরা ঠিক জানে না।
ইকরাম উল্লাহ সাহেবের মালয়েশিয়ার যাবার খবরটি শুনে, তাঁর ভেতর ঠিক কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, রাজীব মনে করতে পারে না। তবে সে আবার তিনতলায় , ইকরাম উল্লাহ সাহেবের আলোবিহীন নি:শব্দ কেবিনের সামনে ফিরে যায়। যদিও জানতো, ইকরাম উল্লাহ সাহেব আসবে না, তাঁকে ডাকার কোন সম্ভাবনা নেই। তবুও সে কালো তুলতুলে সোফায় বসে অপেক্ষা করে। অফিসের বাইরে, জুনের ভ্যাপসা গরম। এর চেয়ে সেন্ট্রাল এসির শীতলতা ঢের আরামের। তাছাড়া, অফিসে দুপুরে খাওয়াটা চলে যায় বিনা খরচে।
বিকেলে পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক উদ্ভট সংবাদে রাজীবের চোখ পড়ে।
নাইজেরিয়ায় উত্তেজিত জনতার হাতে এক পাদ্রী খুন হবার খবর। খবরে প্রকাশ, পাদ্রীর বিরুদ্ধে এক সহকর্মীর যৌনাঙ্গ চুরির অভিযোগ উঠে। আফ্রিকায় যৌনাঙ্গ চুরির অভিযোগটি নতুন কিছু নয়। আশ্চর্যজনক কারণে, অভিযোগকারী অনুভব করে তাঁর জননাঙ্গটি স্বস্থানে নেই। এবং যে মুহুর্ত থেকে অনুভব করে, তাঁর জননাঙ্গ চুরি হয়ে গেছে, সেই মুহুর্তে তাঁর আশে-পাশে থাকা ব্যক্তির বিরুদ্ধেই জননাঙ্গ চুরির অভিযোগটি করে। এবং এধরণের অভিযোগ আফ্রিকায় এতোটাই বিশ্বাসযোগ্য যে, পুলিশকে সে অভিযোগ আমলে নিয়ে, ডাক্তারী পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হয় যে, জননাঙ্গ আসলে চুরি হয় নি।
সংবাদটি বেশ ক'বার পড়ে। সংবাদটি একই সাথে, কিম্ভূত আর কৌতুহল উদ্দীপক। সংবাদটিতে খুব ডিটেইল কোন মনস্তাত্ত্বিক আলোচনা নেই, শ্রেফ ঘটনার বর্ণনা।
বিষয়টি অজানা এক কারণে, রাজীবের মনের ভেতর যেন গেঁথে যায়; অনেকক্ষণ ধরে মাথার ভেতর তা ঘুরতে থাকে, দূর্ভেদ্য চক্রের মতো। তারপর ভুলে যায়।
পর দিন শুক্রবার , মিথ্যে করে কাজের জন্য বেরোতে হয় না তাঁকে। সকাল বেলাটি অলসতায় কাটে। এই ছুটির দিনটিতেই কেবল, রাজীব তাঁর স্ত্রী ও শিশু সন্তানের সাথে কাটানোর সুযোগ পায়। এই একটি দিনই কেবল তাঁর কাছে বাস্তব বলে মনে হয়, বাকী দিনগুলো যেন ঘোর। দুপুরে ছেলে ঘুমিয়ে গেলে, বাইরের অর্ধেক রুমটিতে পাতা বিছানায়, কুসুম এসে তাঁর পাশে শোয়।
তাঁরা কথা বলে। হাত হাতের স্পর্শ পায়, শরীর শরীরের। তারপর যখনই নিবিড় হতে যায়, তখনই সহসা রাজীবের সেই জননাঙ্গ চুরির সংবাদটি মনে পড়ে যায়। রাজীব তাঁর জননাঙ্গের অনুপস্থিতি অনুভব করে। রাজীব যতটা মরিয়া হয়ে, জননাঙ্গের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে উদ্ধত হয়, জননাঙ্গের অনুপস্থিতি ততটাই প্রকট হয়ে উঠে। আতংকিত হয়ে রাজীব ঘামতে থাকে। ঘর্মাক্ত রাজীবকে দেখে ভীত হয় কুসুম। সে দ্রুত এক গ্লাস সরবত করে আনে। কিছুক্ষণ পর রাজীব সুস্থ বোধ করলেও, এক ধরণের অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে, দেড় কামড়ার ফ্ল্যাট বাড়ীতে। রাজীবের মনে হয়, কখন শুক্রবারটি শেষ হবে।
বিষ্যুদবার সকালে হেড অফিসের তিনতলায় গিয়ে রাজীব দেখে ইকরাম উল্লাহ সাহেবের কেবিনে বাতি জ্বলছে। দরজার পাশে টুলে বসে ঝিঁমুচ্ছে একাব্বর মিয়া। রাজীব বুঝতে পারে, ইকরাম উল্লাহ ফিরে এসেছে।
ইকরাম উল্লাহ সাহেবের অফিসে প্রবেশের সময় উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয় রাজীব। তিনি আজ সালাম গ্রহণ করেন না। হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ঢুকে যায়। সকালে বাসভাড়া দিতে গিয়ে , রাজীব খেয়াল করেছে , তাঁর পকেটে আগামী দিন হেড অফিসে আসার মতো যথেষ্ট অর্থ নেই। রাজীব ভাবে, আজ যে করেই হোক, ইকরাম উল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। আজ পত্রিকা না পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
লাঞ্চের পর, রাজীব সোফা থেকে উঠে গিয়ে কেবিনের দরজার একপাশে দাঁড়ায়। উদ্দেশ্য, দরজা খুললেই যেন ইকরাম উল্লাহ তাঁকে দেখতে পায়। পিয়ন একাব্বর মিয়া কিছুক্ষণের জন্য অনুপস্থিত ছিল। ফিরে এসে রাজীবকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্তি প্রকাশ করে।' আপনে আমার চাকরীডা খাইবেন নাকি? যান, অয়েট করেন, সময় হইলে স্যার আপনারে ডাকবো!'
ইকরাম উল্লাহ সাহেবের কেবিন এবং আশেপাশের প্রতিবেশে আজ সকাল থেকেই ব্যস্ততা। মাঝে মাঝেই অফিসের লোকজন ফাইল-পত্তর নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করে। তারপর উৎকণ্ঠিত মুখভঙ্গি নিয়ে বেরিয়ে আসে তারা। অবিরাম চলতে থাকে গত সাত দিনে জমে থাকা মিটিংগুলো।
সাড়ে তিনটা নাগাদ, ইকরাম উল্লাহর দর্শণার্থী হিসেবে আসে পাবলিক রিলেশানসের আরিফা ম্যাডাম। রাজীব তাঁকে চেনে না, এমনকি নামও জানে না। তবে , ইকরাম উল্লাহ সাহেব কুয়ালালামপুর যাবার আগে, প্রতি বিকেলেই হাতে কিছু ফাইল নিয়ে ইকরাম উল্লাহ সাহেবের কেবিনে প্রবেশ করতো। তারপর, বেশ কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসতো। নাম না জানলেও, আরিফা ম্যাডামের আঁটসাঁটো পোষাক, প্রকট লিপষ্টিক আর ঋজু দেহ-ভঙ্গিমা চোখ এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। রাজীবেরও যায় নি। অন্যদিন আরিফা ম্যাডাম সরাসরি কেবিনে ঢুকে গেলেও, আজকে তাকে অপেক্ষা করতে হয়।
আরিফা ম্যাডাম পাশের সোফাটিতে বসে অপেক্ষা করে। আরিফা ম্যাডামের শরীর থেকে সদ্য স্প্রে করা কড়া পারফিউমের গন্ধ এসে রাজীবের নাকে লাগে। রাজীব আঁড় চোখে তাকে দেখে। পায়ের উপর পা তুলে, মোবাইলের স্ক্রীণে কি যেন দেখছে। রাজীব যে তাকে দেখছে, অথবা অন্য সোফাটিতে রাজীবের উপস্থিতি তাকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করে না। কিছুক্ষণ পর, একাব্বর মিয়া কফি নিয়ে আসে আরিফা ম্যাডামের জন্য। এক কাপ। সেন্টার টেবিল থেকে কাপ তুলে আরিফা ম্যাডাম চুমুক দিতেই, রাজীবের মনে হয়, সে সবাইকে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু কেউ যেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছে না। দুপুরে খাবারের সময়ও ক্যাফেটেরিয়াতে সে লক্ষ্য করেছে, হেড অফিসের সবাই সবাইকে চেনে , খাবার খেতে খেতে তাঁরা অফিসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গসিপ করে, খেলা নিয়ে কথা বলে, সিনেমা নিয়ে কথা বলে, শেয়ারবাজার নিয়ে কথা বলে, পদ্মা সেতু নিয়ে কথা বলে। কিন্তু রাজীব বা রাজীবের দিনের পর দিন অনিশ্চিত অপেক্ষা নিয়ে কারো কোন আগ্রহ নেই।
অল্প সময় পরেই , আরিফা ম্যাডাম ইকরাম উল্লাহর কেবিনে প্রবেশ করে । কিন্তু অল্প সময়ে বেরিয়ে আসে না। দিন শেষ হয়ে আসছে। সপ্তাহটিও। রাজীব কিছুটা মরিয়া উঠে। সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অপেক্ষা করার মতো সময়, তাঁর হাতে নেই। আজ কিছু একটা করতেই হবে। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে, ইকরাম উল্লাহ কলিংবেল বাজিয়ে পিয়নকে ডাকে। একাব্বর মিয়া দরজা খুলে চুপি দিতেই, ইকরাম উল্লাহর কণ্ঠ শোনা যায়, 'ড্রাইভারকে গাড়ী বের করতে বলো' । একাব্বর মিয়া, ড্রাইভারের জন্য সন্দেশ নিয়ে ছুটে যায়। একাব্বর মিয়ার অনুপস্থিতিতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় রাজীব।
প্রথমে ইকরাম উল্লাহ বেরিয়ে আসে। রাজীব ঢোঁক গিলে গলা ভিজিয়ে নেয়। ' স্যার আমি রাজীব আহমেদ, আমার ফাইলটা আপনার টেবিলে।'
ইকরাম উল্লাহ কিছু বলে না। যেন রাজীবের ধৃষ্টতা দেখে তিনি অবাক হয়েছেন।
'দুই সপ্তাহ ধইরা এইখানে বইস্যা আছি। আগামী দিন অফিসে আসার বাস-ভাড়া নাই আমার।' নিজের মরিয়া কণ্ঠস্বর নিজের কাছেই অচেনা লাগে রাজীবের।
রাজীবের বলার ধরণ, ইকরাম উল্লাহর পছন্দ হয় না। হাত দিয়ে প্যান্টের বেল্ট ঠিক করে। তারপর কিছু না বলে হেঁটে চলে যায় ইকরাম উল্লাহ।
রাজীব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ইকরাম উল্লাহর পশ্চাদগমনের দিকে। রাজীবের হঠাৎ আবার নাইজেরিয়ার সেই জননাঙ্গ চুরির সংবাদটি মনে পড়ে যায়। ঠিক তখনই দরজা খুলে ইকরাম উল্লাহর কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে আরিফা ম্যাডাম। রাজীব পুনরায় তাঁর নিজস্ব জননাঙ্গের অনস্তিত্ব অনুভব করে। আরিফা ম্যাডাম যখন এগিয়ে আসতে থাকে, তখন সে পুনরায় আতংকিত বোধ করে । সে ঘামতে থাকে। আরিফা ম্যাডামের কড়া পারফিউমের গন্ধ নাকে এসে লাগে। আরিফা ম্যাডাম তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখে না। রাজীবের মনে হয়, সে যে সারাদিন সোফায় বসে থাকে, অথবা দুপুরে খাবার খেতে যায়, কেউ কি তাঁকে দেখতে পায়? অথবা , সে যখন কথা বলে, তখন কেউ কি তাঁর কথা শুনতে পায়? রাজীবের মনে হয়, সে যেন এক পরিপূর্ণ অনস্তিত্ব।
আরিফা ম্যাডাম যখন রাজীবের খুব কাছে চলে আসে, তখন কেন জানি তাঁর এবং তাঁর জননাঙ্গের অনস্তিত্বটি প্রকট আকার ধারণ করে। এর পরবর্তী মূহুর্তে ঠিক কি ঘটেছিল, তা কিছুতেই মনে করতে পারে না রাজীব। থানার হাজতের দেয়ালে হেলান দিয়ে, ঠিক সেই মূহুর্তটির কথা মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই মূহুর্তটির স্মৃতি যেন বড় এক কৃষ্ণবিবর।
রাজীবের মনে হয়, হয়তোবা সত্যি সে আরিফা ম্যাডামকে চুমু খেয়েছিল!
(গল্পটি ছোট কাগজ 'সূর্যকাঁটা'- য় ফেব্রুয়ারী, ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত।)
মর্মন্তদ এক গল্প।
Unnamed
আধুনিক মানুষের এক ট্র্যাজিক পরিণতির গল্প। পুরো সভ্যতা গড়ে উঠেছে স্বার্থপরতার উপর।
শেখর রায়
কমেন্ট করুন: